বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আষাঢ়ের প্রথম দিন আজ

‘ওগো সন্যাসী, কী গান ঘনাল মনে।/গুরু গুরু গুরু নাচের ডমরু/বাজিল ক্ষণে ক্ষণে।/তোমার ললাটে জটিল জটার ভার/নেমে নেমে আজি পড়িছে বারম্বার/বাদল আঁধার মাতাল তোমার হিয়া,/বাঁকা বিদ্যুৎ চোখে উঠে চমকিয়া’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বর্ষা-মঙ্গল’ কাব্যে এভাবেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন লাবণ্যস্নিগ্ধ রূপবতী বর্ষাকালকে।

প্রকৃতি ও প্রেমের আরেক কবি নির্মলেন্দু গুণ বর্ষা বন্দনায় লিখেছেন, “গ্রীষ্ম চলিল, বর্ষা আসিল, আষাঢ়ে নামিল ঢল;/বুনো-পাখি সব ডাকে অবিরল : ‘বাওয়া ক্ষেত কর তল।’/এই তো কখন নেমেছে বৃষ্টি, অবিরাম তবু ঝরছে;/না পেয়ে উপায় রাখালের দল ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরছে।”

বাংলার পথে প্রান্তরে সজল শ্যাম ঘন দেয়া’কে সম্ভাষণ জানানোর সময় বর্ষাকাল। পঞ্জিকার নিয়মে আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। প্রকৃতিতে গ্রীষ্মের রুদ্র খরতাপ মুছে দিয়ে বর্ষায় হবে বৃষ্টির আরাধনা। তৃষ্ণাকাতর জগত বর্ষায় ফিরে পাবে প্রাণের স্পন্দন।

আষাঢ় ও শ্রাবণ এ দুই মাস বর্ষাকাল। আর বর্ষাকাল মানেই মেঘ, বৃষ্টি, প্রেম, নতুন প্রাণ, জেগে ওঠার গান। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাইতো বলেছেন, ‘এই জল ভালো লাগে;- বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে/ধুয়েছে আমার দেহ- বুলায়ে দিয়েছে চুল- চোখের উপরে/তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে,- আবেগের ভরে’। বর্ষা আমাদের মনকে স্নিগ্ধ করে তোলে। পুরাতন জঞ্জাল ধুয়ে মুছে আমরাও জেগে উঠি প্রাণচাঞ্চল্যে।

বর্ষা আমাদের জন্য অপরিহার্য এক ঋতু। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য বর্ষা আসে। বর্ষায় বৃষ্টি না হলে শস্যাদি জন্মাবে না, বেড়ে উঠবে না প্রাণ। বৃষ্টির অভাবে মাটি যখন অনুর্বর হয়ে যায় তখন বর্ষা এসে তা উর্বর করে। আমাদের নদী, মাঠ, ঘাটের দেশ বর্ষায় ভরে ওঠে সবুজে শ্যামলে।

বর্ষার নতুন পানিতে নদীনালা, খাল-বিল পানিতে ভরে ওঠে। সেখানে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। তাই বর্ষা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। বর্ষার এক পশলা বৃষ্টি যে নতুন মাত্রা নিয়ে আসে জীবনে তা অন্য কিছুতেই পাওয়া যায় না।

বর্ষাকাল আমাদের শহুরে ও গ্রামীণ জীবনে ভিন্ন। বর্ষায় বাংলার নদ-নদী পূর্ণযৌবনা হয়ে ওঠে। নদীর ফেঁপে ওঠা জোয়ারের পানি প্রচুর পলি জমায় মাটিতে, যা নিয়ে আসে শস্যের প্রাচুর্যের খবর। এ সময় বিলে ঝিলে ফোটে শাপলা-শালুক। হিজল আর কেয়াফুলের অরূপ দৃশ্য মোহিত করে মনকে।

বর্ষাকাল গ্রামের মানুষকে অনেক বেশি ঘরমুখো করে তোলে। রমণীরা ঘরে বসে নকশিকাঁথায় ফুল তোলে। অনেকটা আলস্যে কেটে যায় দিন। বৃষ্টি বেশি হলে অনেক সময় গরিব মানুষদের হাতে কোনো কাজ থাকে না।

এ সময়ে ফোটে কদম ফুল যা বর্ষার রূপকে বাড়িয়ে দেয়। আরও ফোটে কেয়া ও কেতকী। শহরের একঘেয়ে যান্ত্রিক জীবনে বর্ষা কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলে। বর্ষার বৃষ্টি শহরের আকাশে-বাতাসে থাকা ধুলোবালিকে বশ করে। তবে বর্ষায় শহরের রাস্তাঘাট অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায়; যাতে মানুষের ভোগান্তি বাড়ে।

বর্ষা মানেই আবেগ, অনুভূতির জোয়ার। এ জোয়ারে ভাসেননি এমন কবি, সাহিত্যিক পাওয়া যায় না। শুধু যে কবি সাহিত্যিক তাই নয় সাধারণ মানুষও। কালীদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ বা নির্মলেন্দু গুণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হুমায়ূন আহমেদ কেউ বর্ষাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি।

বাংলাসাহিত্যের খ্যাত-অখ্যাত কবি-সাহিত্যিক সবাই বর্ষার রূপ-ঐশ্বর্যে মোহিত ও মুগ্ধ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী, জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে বা হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’- এ বর্ষা এক বিপুলা বিস্ময় নিয়ে আবির্ভূত।

বাংলার কৃষি বাংলার অর্থনীতিও বৃষ্টিনির্ভর। যথাযথ বৃষ্টিপাত বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় ফসল ফলাতে সহায়তা করে। অন্যদিকে অনাবৃষ্টি ও খরায় বাংলাদেশের কৃষি ভেঙে পড়ে। তাই বর্ষাকাল আমাদের জীবনে সামগ্রিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আজ বর্ষা ঋতুর প্রথম দিন অর্থাৎ আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে প্রতি বছরের মতো এবারও ‘বর্ষা উৎসব-১৪২৬’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। এ উৎসবে বর্ষা ঋতুর ওপর দেশের অগ্রগণ্য দলগুলো ও বরেণ্য শিল্পীদের বর্ষা কথন পর্ব, আদিবাসীদের পরিবেশনা, যন্ত্র সঙ্গীত, দলীয় আবৃত্তি, দলীয় সঙ্গীত ও দলীয় নৃত্য, একক আবৃত্তি, একক সঙ্গীতানুষ্ঠান হবে।

বর্ষা কথন পর্বে অংশগ্রহণ করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মো. আকতারুজ্জামান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট।

সভাপতিত্ব করবেন সংগঠনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. নিগার চৌধুরী। শনিবার সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে অনুষ্ঠানমালা চারুকলা অনুষদের বকুলতলা থেকে সরাসরি সম্প্রচার করবে চ্যানেল আই।

এদিকে সকাল ৭টায় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ঢাকা মহানগর সংসদের আয়োজনে থাকছে বর্ষা উৎসব। অনুষ্ঠানের শুরুতেই উচ্চাঙ্গসঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ইবাদুল হক সৈকত। এরপর একেএকে পরিবেশিত হবে দলীয় নৃত্য, দলীয় ও একক সঙ্গীত ও আবৃত্তি। থাকবে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন শাখার শিল্পীদের পরিবেশনা।

Spread the love