শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দৌলতপুর : সুখি নারীদের আদর্শ গ্রাম

দৌলতপুরের গৃহবধু মিনতি রানী এখন সুখি মানুষ। নিজে লেখাপড়া করতে না পারলেও পড়াতে পারছেন সন্তানদের, তাই সুখি তিনি।  তার দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে তপন কুমার কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেয়ে সুচিত্রা রায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ছোট ছেলে সুমন কুমার গ্রামের একটি স্কুলে ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তিন সন্তানের সবাইকে পড়াতে পারছেন বলে একজন সফল জননীর স্বীকৃতি পেয়েছেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় আয়োজিত জয়িতা অন্বেষণ কর্মসুচীতে। লাভ করেছেন উপজেলা পর্যায়ে জয়িতা-২০১৬ পুরস্কার।

‘আমারো পড়ার ইচ্ছা ছিল, বাবার আগ্রহ ছিলনা। বাবা বলতেন, বিয়ে তো দিতেই হবে, অত পড়ার দরকার কি? তিনি  বিয়ে দিলেন। ক্লাস সিক্সে পরীক্ষা দিছি আর আমার বিয়ে  হলো! পড়া হলো না।’ জানালেন মিনতি।

অথচ পড়ার অদম্য আগ্রহ তার। মেধাবী ছিলেন। পুজোর প্রদীপ ও চাঁদের আলোয় লেখাপড়া করে ৫ম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েছিলেন। তবুও তার পড়া হলোনা। নিজের জীবনের যে বেদনা আজ তা ভুলেছেন সন্তানদের ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরে।

আরেকজন সুখি নারী সাবিত্রি রায়। একদিন খেয়ে না খেয়ে, প্রতিনিয়ত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। এখন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যে আছেন। গার্মেন্টস পণ্য তৈরী করে ব্যবসা করছেন। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে অর্থনৈতিক ক্যাটাগরিতে জয়িতা পুরস্কার লাভ করেছেন ২০১৬ সালে। দ্বীপা রায়, রত্না রায়, রঞ্জনা রানী। মিনতি, সাবিত্রিদের মত সুখি মানুষ তারাও। তাদের কেউ শিক্ষক, কেউ কৃষক। সকলের আর্থ, সামাজিক, সংস্কৃতিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন হয়েছে এবং সবাই এখন সুখে আছেন।

মিনতি, সাবিত্রিরা হলেন দৌলতপুর গ্রামের অধিবাসী। যাকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে পল্লীশ্রী নামের একটি সংস্থা। তাই এর নাম রাখা হয়েছে দৌলতপুর আদর্শ গ্রাম। এই গ্রামের মেয়েরা আনন্দ-বিনোদনে সময় কাটায়, নিজের ও পরিবারের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করে, বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে সক্রিয় থাকে, স্বাস্থ্য সম্মত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়, সন্তানদেরকে শিক্ষিত করার ব্রত নেয় এবং নারীর প্রতি সংিসতা বন্ধে উদ্যোগী থাকে। এ যেন অন্য রকম এক গ্রাম।

পল্লীশ্রী হলো দিনাজপুরের বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, যারা নারী নির্যাতন বন্ধে ও নারীর প্রতি সহিংসতা মুক্ত সমাজ গঠণে কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। সংগঠণটি দৌলতপুর সহ দিনাজপুরের ছয় উপজেলার ২৫টি গ্রামকে আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে নারীর প্রতি সহিংসতা মুক্ত সমাজ গঠণের লক্ষে।

দৌলতপুর দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলা সদর হতে দুই কিলোমিটার দুরের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। আর সব গ্রামের মত এ গ্রামেও আছে মেঠো পথ, সবুজ ক্ষেত, পুকুর, দিঘি, মাটির-খরের-ইটের ঘর-বাড়ি। কিন্তু এই গ্রামের মেয়েদের মধ্যে অনাবিল আনন্দ আর সুখের যে ফোয়ারা তা হয়ত আর সব সাধারণ গ্রামে নেই। মিনতি বলেন, আমরা সন্তানদের যেন উচ্চ শিক্ষা দেই, মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে না দেই সেই সেই সব ধারনাগুলো পল্লীশ্রীর আপারা দিয়েছে। তারা আমাদেরকে সুখে-শান্তিতে রাখার যে সকল পদক্ষেপ নিয়েছে তা আমাদের জীবনধারা পাল্টে দিয়েছে।

দৌলতপুর আদর্শ গ্রামের নিজস্ব কার্যালয় আছে। এ কার্যালয়ে পরিচালিত হয় নারী ক্লাব, কিশোর-কিশোরী ক্লাব, যুব ক্লাবের কার্যক্রম। এখানে আদর্শ গ্রাম কমিটি ও ক্লাব কমিটিগুলো মাঝে মাঝে মিটিং, সভা করে থাকে এবং গুরুত্বপুর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কার্যালয়টি গড়ে উঠেছে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী সাবিত্রির জায়গার উপর। এর জন্য তিনি কোন ভাড়া নেন না। এই কার্যালয়ে নারী ক্লাব ও কিশোর-কিশোরী ক্লাবের সদস্যরা কখনো যৌথভাবে, কখনো আলাদাভাবে সভা, সচেতনতা সৃষ্টিমুলক সভা, অনুষ্ঠান, বিনোদন, গান-বাজনা, নাটিকা ইত্যাদি করে থাকেন।

২৬ বছরের দীপা রায় বলেন, অভাব-অনটনের কারণে ৮ম শ্রেণীতে পড়ার সময় আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের প্রথম দিকে স্বামী এখানে আসতে দিতে চাইত না। বলত, ওখানে গিয়ে কি করবে? নেতা হবে? এখন নিষেধ করেনা, বরং উৎসাহ দেয়। এখন স্বামীই বলে, যাও তোমাদের মিটিং আছে। অনেক সময় স্বামী জানতে চায়, আজকে তোমাদের কি হলো?

স্বামী আগে ছিলেন নেগেটিভ, এখন পজেটিভ! স্বামীর মনের এই পরিবর্তনের কারণ কি? জানতে চাইলে দীপার স্বামী শিশু চন্দ্র রায় বলেন, বউ ছিJewl Vai 2ল নতুন। তাই যেতে দেইনি। পরে বুঝতে পারি যে, আদর্শ গ্রাম কর্মসুচিতে মেয়েদেরকে যে সব কথা বলা হয়, সেগুলো শুধু তাদের জন্য নয় আমাদের পুরো পরিবারের জন্য, এমনকি গ্রামের সকলের জন্য ভাল। তাই আর নিষেধ করি না। এমনকি আমাকে ডাকলে আমিও কোন কোন সভায় অংশ নিয়ে থাকি।

রত্না রায় হলেন দৌলতপুর নারী ক্লাবের আহ্বায়ক। বি.এ পাশ এবং একটি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। বললেন, বাল্য বিয়ে বন্ধের জন্য আমরা ভীষণ তৎপর। আমাদের তৎপরতার কারণে এই গ্রামে বাল্য বিয়ে অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। তারপরেও বলতে দ্বিধা নাই যে, ব্যাপক তৎপরতা সত্বেও এখনো এ ধরণের বিয়ে হচ্ছে। তবে সেটা প্রকাশ্যে না হয়ে গোপনে হচ্ছে।

রত্নার স্বামী কালি কুমার রায়ও একজন শিক্ষক। আদর্শ গ্রাম কর্মসুচিতে তৎপর থাকেন তিনি। তিনি জানালেন যে, তিনি বাল্য বিয়ে বন্ধের পক্ষে। কারন এ ধরণের বিয়ে মেয়েদের শারিরীক ও মানসিক ক্ষতির অন্যতম কারণ। এটা নারীর প্রতি এক ধরণের সহিংসতাও। কালি কুমার বলেন,  বাল্য্য বিয়ে  বন্ধে পল্লীশ্রী যে চেষ্টা চালাচ্ছে আমি তাকে সমর্থন করি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, সচেতন বাবা-মা’রাও অনেক সময় বাল্য বিয়েতে যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। প্রকাশ্যে দিতে পারেনা বলে গোপনে দিচ্ছেন। ফলে আমাদের লক্ষ্য অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে।

খবর নিয়ে জানা গেল, নারী নির্যাতন প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে পল্লীশ্রী দিনাজপুর সহ দেশের ৭টি জেলায় কাজ করছে। নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত গ্রাম গঠণের লক্ষ্যে ‘নিজেদের গ্রাম নিজেরা’ গড়ি শ্লোগান দিয়ে আদর্শ গ্রাম কর্মসুচি হাতে নিয়েছে ২০০৯ সালে, যার সূচনা হয়েছিল চিরিরবন্দরের ব্রম্মপুর গ্রামে। পর্যায়ক্রমে এই কর্মসুচি ছড়িয়েছে কাহারোলের দৌলতপুর, বনড়া, রামচন্দ্রপুর, সুন্দইল, বীরগঞ্জের মাঝবোয়াল, চৌপুকুরিয়া, চকমহাদেব, ব্রাম্মভিটা, বিরলের ঢেলপীর, দামাইল, কাশিজঙ্গা, ভগবানপুর, দিনাজপুর সদরের নিশ্চিন্তপুর, গোয়ালপাড়া, সব্জীবাগান, মিয়াজীপাড়া, বড়মনিপুর, চিরিরবন্দরের শিবকুড়ি, ব্রম্মপুর, অমরপুর, বাসুদেবপুর, ফুলবাড়ীর পাকাপান, সূর্যপাড়া, জামাদানী ও মুক্তারপুর গ্রামে। এই সব লক্ষ্য অর্জনে গৃহীত কর্মসুচিতে নারী-পুরুষ সবাই অংশ নিয়ে থাকেন। তবে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেশি থাকে।

দৌলতপুর আদর্শ গ্রাম কমিটির সভাপতি মিনতি রানী বলেন, গ্রামের কাজে আমরা সবাই এক সাথে থাকি। ইউএনওর কাছে, চেয়ারম্যানের কাছে, এমপি’র কাছে আমরাই যাই। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা সহ যে সকল সরকারি সুযোগ-সুবিধা আছে তার জন্য আমরা জায়গা মত ধর্ণা দেই। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি সবাই আমাদেরকে চেনেন এবং আমাদের কাজ করে দেন।

২০১৫ সালের  ১৬ জুন পল্লীশ্রী পরিচালিত ২৫টি আদর্শ গ্রামের সমন্বয়ে একটি মিলন মেলা হয়েছে দৌলতপুরে।  মিলনমেলায় আদর্শ গ্রাম কমিটি, নারী ক্লাবের  নেতৃবন্দ ও উপকারভোগীরা তাদের সাফল্য ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেছেন। সেই মিলন মেলায় এলাকার সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল. উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ, তারগাঁ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আ শ ম মনোয়ারুজ্জামান সহ গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। তারা দৌলতপুর আদর্শ গ্রাম সদস্যদের একটি টিউবওয়েল ও ২টি সেলাই মেসিন উপহার দেন।

পল্লীশ্রীর নির্বাহী প্রধান শামীম আরাNari Clab বলেন, আদর্শ গ্রামগুলোতে ১০-১২ বছর আগে পল্লীশ্রী প্রথমে ছোট ছোট দল গঠণ করে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের ভেতরে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়নের চেষ্টা চালানো হয়। এরই এক পর্যায়ে আদর্শ গ্রাম কর্মসুচি গ্রহণ করা হয়। আদর্শ গ্রাম সম্পুর্ণরুপে পল্লীশ্রীর নিজস্ব উদ্ভাবিত একটি কর্মসুচি। যে গ্রামের শতভাগ শিশু স্কুলে যায়, শতভাগ শিশুর জন্মনিবন্ধন হয়, শতভাগ বিয়ে রেজিষ্ট্রেশন হয়, শতভাগ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার ও বিশুদ্ধ পানি পান করে, যে গ্রামে বাল্য বিয়ে ও নারী নির্যাতন হয় না, নারীর প্রতি সহিংসতা মুক্ত গ্রাম গঠণে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষ সংবেদনশীল থাকেন ও কার্যকর ভূমিকা রাখেন। আমরা মনে করি যে, এমন গ্রাম হলো আদর্শ গ্রাম। আমরা এই রকম গ্রাম গঠণের লক্ষে কাজ করে যাচ্ছি। যৌথ পরিবারে সমাজবদ্ধ হয়ে পারস্পরিক বন্ধণের মধ্যে বসবাস করা ও মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো আমাদের সমাজের ঐতিহ্য। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এগুলো এখন ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমরা আদর্শ গ্রাম কর্মসুচির মাধ্যমে সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছি নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা মুক্ত পরিবেশ তৈরী ও মূল্যবোধ সৃষ্টির লক্ষে। আমরা বিশ^াস করি, মানুষ যখন নিজেদের গ্রাম নিজেরা গড়ার চেষ্টা করবে তখন নারীর প্রতি সহিংসতাও বন্ধ হবে।

পল্লীশ্রীর ‘নারীর ক্ষমতায়নে সুযোগ সৃষ্টি প্রকল্প’র সমন্বয়কারী মোঃ সেলিম রেজা জানালেন, ব্রেড ফর দ্যা ওয়ার্ল্ড- জার্মানী’র সহায়তায় আদর্শ গ্রাম কর্মসুচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আমাদের বিশ^াস যে, এই কর্মসুচি একদিন সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে। তখন শুধু দু-চারটি গ্রাম নয় সারা বাংলাদেশের সকল নারী ও পুরুষ সুখি মানুষে পরিনত হবেন।

দৌলতপুর আদর্শ গ্রামের মনোরঞ্জন রায়ের স্ত্রী রঞ্জনা রানীর শারীরিক সমস্যা জনিত কারণে মা হতে পারেননি। তাই স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে দিয়েছেন নিজেই। সতীনের সন্তান এখন তার নিজের সন্তানের মত। তারা তাকে মা বলে ডাকেন। এখন এখন সুখি নারী তিনি। এই সুখ আরো পল্লবিত হয় যখন তিনি সহ নারী ক্লাবের সদস্যরা একসাথে বসে খোশগল্প এবং গান-বাজনায় যুক্ত হন। রঞ্জনা বলেন, ক্লাবে বসে নিজের মত করে সময় কাটাতে পারি। সুখ-দুঃখের গল্প অন্যদের সাথে শেয়ার করতে পারি। এই ক্লাব আমাদেরর সন্তানের মত। বাড়িতে সন্তানদের সাথে থাকতে ভাল লাগে। বাইরে ক্লাবে সময় কাটাতে ভাল লাগে। এর মধ্য দিয়ে নিজের ভেতর সুখ অনুভব করি।

 

লেখক–আজহারুল আজাদ জুয়েল

সাংবাদিক ও কলামিষ্ট                                                                                                                               পাটুয়াপাড়া, দিনাজপুর, মোবাঃ ০১৭১৬৩৩৪৬৯০

 

Spread the love