অত্যন্ত ভদ্র মিষ্টভাষী মানুষ রাহাত স্যার, ঠিক তেমনি ভাবীও।সুখী পরিবার। তার পরিবারের সাথে দীর্ঘদিনের জানা। সেই দুই দশক আগের কথা। ঘরে মিস্টি এক মেয়ে রীতি আর লাজুক ছোট্ট এক ছেলে সালাত।খুব ভালো লাগত তাদের দেখতে।আমার নতুন সংসার। স্বপ্ন দেখতাম ঠিক এমন একটি পরিবারের।
চাকুরীর চিরাচরিত নিয়মে একদিন আলাদা হতে হয়। দীর্ঘ দিনের না দেখায় সব কিছুই অতীত হতে থাকে। কাজের ব্যস্ততায় হয়ত মাঝে মাঝে ফোনালাপ। তবে ভালোবাসা রয়ে যায় মনের গভীরে।
রীতির বিয়ের খবরে খুব ভালো লেগেছিল। পূর্ব পরিচয় সুত্রে বিয়ে। কিছুদিন পরে ঘরে ফুটফুটে এক সন্তান। নানা হওয়ার আনন্দে রাহাত স্যারের সে কি আনন্দ। আমিও খুব উচ্ছসিত হয়েছিলাম। এর পরে বেশ কিছু দিন খবর নেয়া হয়নি।
সেদিন সন্ধ্যায় মনে হলো স্যার এর খবর নেই। তার গলা শুনেই মনে হোল কি যেন এক অস্থিরতা। একথা সেকথায় জানতে পেলাম রীতি এখন আলাদা থাকছে বাবা মার সাথে। শ্বশুর বাড়ীতে বনিবনা (Adjust) হচ্ছে না। খবরটি শুনে খুবই মর্মাহত হলাম। মনে হচ্ছিল আমি কি ভুল শুনলাম।বিড় বিড় করে বলতে থাকলাম, এই ফেরেশতার মত মানুষটার হাতে গড়া সন্তানের সাথে কারও বনিবনা হবে না এটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু সেটিই কঠিন বাস্তবতা।
আজকের দিনে হয়ত এ গল্পটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন ঘটনা কমবেশি সব পরিবারেই খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা কিনা এক দুই দশক আগে খুব একটা চোখে আসত না।তাই প্রায়শ আমি ভীত সন্ত্রস্ত হই যখন আমার আদরের সন্তানদের দিকে তাকাই। বাবা মায়েদের কত আদরের এই সন্তান Adjust করতে পারছেনা আমাদের মত বাবা মায়েদের কাছে।আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাশুড়ি বৌয়ের (ইনারাই একজন মা আর অন্যজন মেয়ে) আঙ্গুল একে অন্যের দিকে। কি আশ্চর্য, যাদের কোল সন্তানদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়ের জায়গা সেই অভয়ারণ্যই কিনা পর্যায়ক্রমে সময়ের পরিক্রমায় তৈরী হয় রন ক্ষেত্রে। শুধুমাত্র চরিত্রের পরিবর্তন মাত্র- মাঝ খানে শুধুমাত্র সময়।
এখানে কার দোষ সেটি মুখ্য বিষয় নয়।প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমন হচ্ছে। এক পরিবারে মনোমালিন্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে তা রুপ নেবে বিচ্ছেদের।তা কি করে হয়। আমরা সুন্দর সুখী পরিবার নিয়ে বসবাস করি এটিইত আমাদের সমাজের ও সংস্কৃতির অহংকার। পাশ্চাত্যের জীবন ব্যবস্তার সাথে এটিইত আমাদের পার্থক্য। তাহলে কোথায় জানি একটা গলদ থেকে যাচ্ছে।
এর কারন খুজতে গিয়ে প্রায়শ আমার মনে হয়েছে, আমরা আজকাল সন্তান পালনে অতিব সজাগ। তাদেরকে তাদের মত করে বড় হতে শিখাই না। না চাইতে পাওয়ার অভ্যাস তাদেরকে অনেক বেশী জেদী করে তুলছে। ছাড় দেয়ার মানসিকতা লোপ পাচ্ছে । তাদের সব কাজ করে দিতে দিতে তাদের আমরা অকরমন্য করে তুলছি। অতি ভালবাসার আতিসাজ্যে তাদেরকে আত্ন নির্ভরশীল হতে শিখাচ্ছিনা। সমাজের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে তাদের তৈরী করছিনা। সকল সমস্যা বাবা মারাই সামাল দিতে চান। এমনকি তাদের বিবাহোত্তর একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান বাবা মা এর দ্বারা নিয়ত্রিত হওয়ার প্রবনতাও লক্ষ্য করা যায়। তাই দুর্বল মেরুদন্ডের সন্তানেরা বুঝে উঠতে পারছেনা কিসে তাদের সুদুরপ্রশারী মঙ্গল।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের বাবা মারা অনেক কঠিন অনুশাসনের মধ্যে আমাদের বড় করেছেন। তার অর্থ এই নয় সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসার কোন কমতি ছিল।তাই বলে পরিবারে কোন সমস্যা যে ছিল না তা বলবনা। তবে নৃশংস সিদ্ধান্তের অনলে অবিরত আত্নাহুতির ঘটনা অনেক কম ছিল।
এটিই কি মেনে নিতে হবে যুগের পরিবর্তন বলে। শুধুই সময়ের স্বাভাবিক পরিনতি হিসেবে মেনে নেওয়া কি কখনও এর উত্তর হতে পারে ।যদি তাই হবার তবে এ নিয়েই রাহাত স্যারদের ভালো থাকতে হবে।
লেখক-এটিএমএ মতিন।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা।